Sunday, December 16, 2012

কাসা পিতলের ছোট্ট দেশ গোমনাতি একসময় শোনা যেত বাষের গর্জন

0 comments
আপেল বসুনীয়া : ফাতেমা বেগমের কানে এখনও ধব্বনি হয় ওই ডাক৷ কেউ কেউ বলেন বাষের গর্জন৷কিশোরী বয়সে যখন বউ হয়ে আসেন গোমনাতিতে তখন ভীত হয়েছিলেন ওই শব্দ শুনে৷বয়সের ছাপ পড়েছে তার শরীরে৷ ছেলে-মেয়েদেও বিয়ে দিয়েছেন৷ তবুও ভেঙ্গে পড়েননি৷সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন৷তারপরও অভাব পিছু ছাড়েনা৷ ফাতেমা বেগমের বাবার বাড়ী ডিমলা উপজেলার ছাতনাই ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামে৷ এটি প্রত্যন্— গাঁ৷ওই গময় অজোপাড়াগাঁয়ে ছিলনা বিদ্যুত্, পাকা রাস্—াও ছিলনা৷মেঠো পথে চলত পর“-মহিষের গাড়ী৷ গর“গাড়ীতে চেপে যখন শ্বশুরবাড়ী আসেন ফাতেমা, তখন চোখ ছিল তার স্বপ্ন৷কাসা-পিতলের যেন ছোট্ট দেশ গোমনাতি৷ ডোমার উপজেলার একটি ইউনিয়ন৷ এক সময় রংপুর জেলার ভূগোলে লেখা গোমনাতি কাসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত৷এখানে চমত্কার বাসনপত্র তৈরী হতো৷ ফাতেমা বেগমের শ্বশুর মরহুম আঃ হামিদের ছিল ওমর কাসা-পিতলের বাসনপত্র তৈরীর কারখানা৷ তিনি ব্যবসা করতেন ঘোড়ায় চড়ে৷ ছিল আবাদি জমি৷ফাতেমার স্বামী আতিয়ার রহমানও ছিলেন একই পেশায় জড়িত৷বেশ সচ্ছল ছিল ওদের পরিবার৷ আস্—ে আস্—ে বিলুপ্ত হতে থাকে কাসা-ডিতলের বাসনপত্র৷যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলে আসে এলুমিনিয়াম, িস্টল, প¬াস্টিক আর মেলামাইন৷ যদিও এখানে হিন্দুদের বিয়েতে প্রথা অনুযায়ী কাসার বাসন দরকার হয়৷কিন্তু দাম খুব বেশী৷ এক সময় আভিজাত্য প্রকাশ পেত কার কতটা কাসা-পিতলের বাসনপত্র আছে৷স্বাধীনতা উত্তর দু’বছর পরও গোমনাতিতে এই ব্যবসা ছিল রমরমা৷ অকে ব্যবসায়ীর বসবাস ছিল এই ইউনিয়নটিতে৷ কথিত আছে এই এলাকা ঘুওে গেছেন তত্কালীন পাকিস্—ানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন৷
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখানে সফওে এসেছিলেন ১৯৯৪ সালে৷ এই এলাকার বাসিন্দারা তাকে (প্রধানমন্ত্রী) উপহার দিয়েছিল জুড়ানো কাসার উপঢৌকন৷ প্রধানমন্ত্রী বিলুপ্ত হওয়া কাসা-পিতল তৈরীর কাজে নিয়োজিত পেশাজীবীর সাহায্যেও জন্য হাত বাড়ান৷ কিন্— চাহিদা না থাকায় ওরা এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ে৷ এখন মাত্র ১৫টি ওমর পরিবার এখানে বসবাস করে৷ এরা হলো সহিদুল ইসলাম, নূও মোহাম্মদ, আনিছুর রহমান, জহির“ল হক, নজর“ল ইসলাম, লতিফর রহমান, মশিয়ার রহমান, মমতাজ আলী, লুত্ফর রহমান, আবু হোসেন বুলু, খায়র“ল ইসলাম, ওয়ালেব, খোকাবুড়া ওসমান আলী ও রফিকুল ইসলাম৷ এদের সহিদুল ইসলাম করেন বাঁশের ব্যবসা৷ তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ জন৷ বড় ছেলে নূরজ্জামান (২৪) ৮ শ্রেণী পর্যন্— পড়েছিল৷ কাসা-পিতলের বাসন তৈরী করতে জানতো সে৷ এসএসসি পাস করা মেয়ে সবিনা পারভীনের (২২) বিয়ে দিয়েছেন৷ ৩য় সন্—ান কামর“জ্জামান পড়ে দশম শ্রেণীতে৷ সবচেয়ে ছোট মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন ৮ম শ্রেণীতে পড়ে৷ সহিদুল বলেন,আমি ছিলাম সবচেয়ে বড় কাসা-পিতলের মহাজান৷ কাসা-পিতলের বাসনপত্র তৈরীতে পটু ছিলেন রফিকুল (৪৮)৷ তার হাতের গড়া জগ,বাটি,পানের ডাবলা,থালা ছিল চোখ ধাঁধানো৷ সবচেয়ে বেশী চাহিদা ছিল হামুদাস্—া৷ এখন গোটা ইউনিয়ন মিলে ওমর ১০/১২টা বাসনপত্র পাওয়া যাবেনা৷ বর্তমানে এলুমিয়ামের বাসনপত্র তৈরী করেন তিনি৷ কিন্— আগের মতো সচ্ছলতা নেই৷তিনি জানান, কাসা-পিতলের কাঁচামাল ওরা সংগ্রহ করতেন ভারতের হলদিবাড়ী, জলপাইগুড়ি, কচুবিহার হতে৷ মাটির ফ্রেমের মধ্যে গলানো কাসা-পিতল দেয়া হতো৷তারপর আস্—ে আস্—ে কওে তৈরী করা হতো সুদৃশ্য বাসনপত্র৷নয়ন জড়ানো এসব জিনিস ছিল ধনীদের ঘরে৷ কাসা-পিতল গলানোর জন্য ছিল আলাদা চিমনি৷ কয়লা ছিল এর প্রধান জ্বালানী৷ এখন কাসার দাম প্রতি কেজি সাড়ে ৮শ টাকা৷ আগে ছিল ৫০/৬০ টাকা৷ আর এক কারিগর দোলোয়ার হোসেন৷ তার মেয়ে মরিয়ম আক্তার র“মী৷ একই এলকার শহীদ জিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রীরা ওর কাছে কাসা-পিতলের কথা রূপকথা গল্পের মতো লাগে৷ সে বলে, শুনেছি দাদাদের ছিল ওই কাসা-পিতল বাসনপত্র তৈরীর কারখানা৷ আমাদের কোন অভাব ছিলনা৷ খোকাবুড়ার স্ত্রী মফেজা (৬০) বললেন, তখন আমাদের এমন অবস্থা ছিল যে মেয়ের বিয়েতে দিয়েছিলাম কয়েক ভরি সোনার গহনা৷ এখন মেয়েরা বাপের বাড়ীতে বেড়াতে এলে আমাদের সাথে উপোস থাকে৷
ওই এলাকার প্রবীণ চিকিত্সক মজিবর রহমান এবং দ¶িণ আমবাড়ী গ্রামের যুবনেতা শাহাজাহান সরকার বাচ্চু জানান, সত্যিই কাসা-পিতলের বাসনপত্র তৈরীর শব্দ মতো বাষের গর্জন৷ এখাকার তৈরী বাসনপত্র রপ্তানি হতো বিভিন্ন জেলায় এমনকি ভারতে সওদা হতো বেশী৷ কাসা-পিতলের বাসনপত্র হারিয়ে গেছে৷ এই পেশা ছেড়ে কেউ শি¶কতা, েকউবা ভ্যানচালক, কেউবা রিকশা- সাইকেলের মেকার, কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজ করে৷ অধিকাংশের সচ্ছলতা নেই৷পুণর্বাসনের সুযোগও হয়নি৷ কিন্— ঐতিহ্য ছিল৷ তখন আজকের মতো ছিলনা পাকা সড়ক, িবদ্যুত্সহ দুরালাপনী ব্যবস্থা৷
ফাতেমা বেগমের স্বামী এখন পুরাতন বাসনপত্রের মেরামতের কাজ করেন৷ অনেকটা ফেরিওয়ালা হিসেবে৷পাঁচ সদস্যের পরিবারের নিজের ভিটেটুকু নেই৷ অভাবের তাড়নায় বেচে দিয়েছে ওরা সহায়-সম্বল৷ কখনও কখনও আধাবেলা না খেয়ে চলছে জীবনযাপন৷
কিন্— ফাতেমা বেগম ভূলতে পারেননি সেই স্মৃতি৷ এখনও তিনি শুনতে পান ওই বাষের গর্জন৷

0 comments:

Post a Comment